হিন্দুধর্মীয় স্থানসমূহ

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - হিন্দুধর্ম শিক্ষা - দ্বিতীয় অধ্যায় | | NCTB BOOK
3

 

  • তীর্থস্থান ভ্রমণ/ভিডিও দেখা/ বড় কোনো মন্দির পরিদর্শন। তীর্থযাত্রীর কাছে গল্প শোনা/ইতঃপূর্বে পরিচিত হওয়া ইত্যাদি অভিজ্ঞতার আলোকে যে-কোনো একটি হিন্দুধর্মীয়স্থানের উল্লেখযোগ্য বিষয় সম্পর্কে লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করো।

 

হিন্দুধর্মীয় স্থানের পরিচিতি

 

হিন্দুধর্মীয় স্থানের নাম: 
অবস্থান: 
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য

১.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

২.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

৩.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

৪.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

৫.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  • এবার দলে দলে/জোড়ায় আলোচনা করে আরও যেসব ধর্মীয় স্থান বা তীর্থস্থানের কথা জেনেছ, সেগুলোর মধ্য থেকে পাঁচটির নাম ও অবস্থান লেখো।

 

ছক ২.১১: তীর্থকথা

 

তীর্থস্থানের নাম

অবস্থান

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তীর্থ শব্দের অর্থ 'অবতরণের স্থান'। দেবতা, মহাপুরুষ বা মুনি-ঋষিদের জন্ম বা অবতরণের পুণ্যস্থানই তীর্থস্থান বা তীর্থক্ষেত্র। জগতের মঙ্গলের জন্য তাঁরা পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নেন। আবার প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁদের জীবন তথা লীলাকর্মের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র ভূমিও তীর্থস্থানের অন্তর্ভুক্ত। তীর্থস্থান দর্শন করে মন পবিত্র ও নির্মল হয়, পুণ্যলাভ হয়। পুণ্যলাভ করে মানুষ স্বর্গবাসী হতে পারে। আবার কামনা-বাসনা শূন্য হৃদয়ে মানুষ বিশ্বস্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে চায়। একে বলা হয় জীবনমুক্তি বা মোক্ষলাভ।

 

এবারে আমরা হিন্দুধর্মীয় কিছু পুণ্যস্থান বা তীর্থক্ষেত্র সম্পর্কে জানব।

 

সপ্ততীর্থ

 

অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার, কাশী বা বারাণসী, কাঞ্চী, অবন্তিকা ও দ্বারকা- এই সাতটি তীর্থকে একসঙ্গে সপ্ততীর্থ বলা হয়। এ বিষয়ে হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে-

অযোধ্যা মথুরা মায়া কাশী কাঞ্চী অবন্তিকা। 

পুরী-দ্বারাবতী চৈব সপ্তৈতা মোক্ষদায়িকাঃ।। (পদ্মপুরাণ, ভূমিখণ্ড)

 

সরলার্থ: অযোধ্যা, মথুরা, মায়া বা হরিদ্বার, কাশী বা বারাণসী, কাঞ্চী বা কাঞ্চীপুরম, অবন্তিকা বা উজ্জয়িনী এবং দ্বারাবতী বা দ্বারকা এই সাতটি তীর্থ মানুষকে মোক্ষ দান করে।

 

সপ্ততীর্থের মধ্যে অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার এবং বারাণসী বা কাশী এই চারটি তীর্থের বর্ণনা দেওয়া হলো

 

অযোধ্যা

 

ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত একটি শহর অযোধ্যা। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের জন্ম ও লীলাভূমি হলো অযোধ্যা। শাস্ত্রে তাই অযোধ্যাকে সপ্ততীর্থের অন্তর্গত পবিত্র তীর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অযোধ্যায় প্রথমে চোখে পড়ে মহাবীর হনুমানের মন্দির 'হনুমানগড়'। লঙ্কা-জয় শেষে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানও অযোধ্যায় আসেন। হনুমানকে এই হনুমানগড়ে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। টিলাসদৃশ উঁচু জায়গায় মন্দিরটির অবস্থান। হনুমানের সঙ্গে এখানে রাম-সীতার পূজা করা হয়।

 

 

 

কণকভবন অযোধ্যার একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির। এখানে স্বর্ণালংকারে ভূষিত রাম-সীতার মূর্তি রয়েছে। বিয়ের পর রাম ও সীতা মিথিলা থেকে অযোধ্যায় ফিরে আসেন। তারপর তাঁরা কণকভবনে বসবাস করতে থাকেন। এখানে রাম-সীতার নিত্যপূজা করা হয়।

 

অযোধ্যায় রঘুবংশের কুলগুরু ঋষি বশিষ্ঠের একটি আশ্রম আছে। হিন্দি ভাষায় রামায়ণ-রচয়িতা তুলসী দাসের নামে এখানে 'তুলসী স্মারক ভবন' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে রামলীলা ও কীর্তন হয়।

তীর্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান সরযূ নদী। এখানে অনেকগুলো শানবাঁধানো ঘাট রয়েছে। যার মধ্যে রামঘাট সর্বশ্রেষ্ঠ। এই ঘাটে রামচন্দ্র দেহত্যাগ করার জন্য নদীর জলে নামেন। ঠিক তখনই ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে রামকে বিষ্ণুর জ্যোতিতে প্রবেশ করতে অনুরোধ করেন। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র বিষ্ণুর জ্যোতির সঙ্গে মিশে যান। রামের অনুগামীরাও এই স্থানে নদীর জলে দেহত্যাগ করে দিব্যলোক প্রাপ্ত হন। তাই এই ঘাটকে রামচন্দ্রের মহাপ্রস্থান ঘাট বলা হয়। ঘাটের জলে সিক্ত হয়ে পাপমুক্ত হওয়া যায়। এখানে পিতৃতর্পণ করলে পিতামাতা স্বর্গবাসী হন, ভক্তদের এমন বিশ্বাস রয়েছে। রামঘাটের পাশেই লক্ষ্মণঘাট। নদীর যে স্থানে লক্ষ্মণ যোগবলে দেহত্যাগ করেন, সেই স্থানের নাম লক্ষ্মণঘাট।

 

অযোধ্যার সবচেয়ে বড় উৎসব দুটি- রামনবমী ও দীপাবলি। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ঐ তিথিতে পালন করা হয় রামনবমী। আবার, লঙ্কা-জয় শেষে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে আসেন। অযোধ্যাবাসীরা আনন্দিত হয়ে সেদিন মাটির প্রদীপ জ্বালায়। রামকে অভিনন্দন জানায়। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে এই উৎসব উদ্যাপিত হয়। অমাবস্যার অন্ধকারে গঙ্গার ঘাটগুলো তখন আলোকময় হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থী এই উৎসবে যোগ দেন।

 

ভারতের বড় শহর গুলো থেকে ট্রেনে বা বাসে চড়ে যাওয়া যায়। অযোধ্যা ক্যানটনমেন্ট স্টেশন থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব দশ কিলোমিটার। অটোরিকশা বা ট্যাক্সিতে করে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।

 

মথুরা

 

উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলার একটি প্রাচীন শহর মথুরা। এর পাশেই বৃন্দাবন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে মথুরায় কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য ও কৈশোর লীলা অতিবাহিত হয় বৃন্দাবনে। ভক্ত ও ভগবানের লীলামাহাত্ম্যে পূর্ণ এই দুটি স্থান। এসব মিলে মথুরা তীর্থ। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার মন্দির রয়েছে। প্রধান প্রধান মন্দির ও শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্যের কিছু অংশ এখানে বর্ণনা করা হলো

কেশবমন্দির: মথুরা শহরে অবস্থিত এটি একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের মূল বেদির বামপাশে রয়েছে জগান্নথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার ছবি। ডানপাশে রয়েছে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বিগ্রহ। কাছাকাছি রয়েছে মহাবীর হনুমানের মূর্তি। মন্দির-চত্বরের ভিতরে একটি ছোট মন্দির রয়েছে, যাকে কংসের কারাগার বলা হয়। এই কারাগারে বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। জন্মের সময় বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে নারায়ণের চতুর্ভুজ মূর্তিরূপে দেখতে পান। সেই মূর্তিই এখানে পূজিত হয়।

 

দ্বারকাধীশমন্দির: দ্বারকাধীশ অর্থ দ্বারকার অধীশ্বর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ। মন্দিরে তাঁরই বিগ্রহের পূজা দেওয়া হয়। পাশে রয়েছে প্রভু নিত্যানন্দের মূর্তি।

 

রঙ্গভূমি: রঙ্গভূমি অর্থ রণভূমি বা যুদ্ধভূমি। যমুনা তীরের এই স্থানে কংসের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কংস নিহত হয়। এটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত। 

বিশ্রামঘাট: কংসকে বধ করে পরিশ্রান্ত কৃষ্ণ যমুনাতীরের এই ঘাটে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। যমুনার চব্বিশটি ঘাটের মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে পিতৃতর্পণ করলে পিতামাতা স্বর্গবাসী হন, এ রকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে।

 

কালীয়নাগঘাট: কালীয়নাগ সহস্র ফণাযুক্ত একটি বিষধর সাপ। শ্রীকৃষ্ণ এই স্থানে তাকে দমন করে বৃন্দবনবাসীকে রক্ষা করেন। সে কারণে ঘাটের নাম হয়েছে কালীয়নাগ ঘাট। 

বাঁকে বিহারীমন্দির: বৃন্দাবনের মন্দিরগুলোর মধ্যে এটি একটি বড় মন্দির। এখানে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি পূজা করা হয়। স্বামী হরিদাস নিধুবনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি পেয়ে এই মন্দিরে স্থাপন করেন। 

রাধা-দামোদরমন্দির: ষড়-গোস্বামীর অন্তর্গত জীবগোস্বামী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি এখানে সেবিত হয়। 

শ্রীরঙ্গনাথ মন্দির: এখানে অনন্তনাগের ওপর শায়িত অবস্থায় ভগবান বিষ্ণুর বিগ্রহ রয়ছে। মন্দিরের দেয়ালে অনেক চিত্র আছে। এখানকার মিউজিয়ামে শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্যর নানান মূর্তি রয়েছে।

মদনমোহনমন্দির: অনেক উঁচু বেদির উপর অবস্থিত মদনমোহনমন্দির একটি সুদৃশ্য মন্দির। সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে মূল বেদিতে উঠতে হয়। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব নকশা রয়েছে। এই মন্দিরের পেছনে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সমাধি আছে

 

 

নিধুবন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তদের মিলনভূমি হলো নিধুবন। এখানে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা ও গোপীরা বিরাজ করতেন। পুরো বনটি তুলসীগাছে পূর্ণ। 

গোবর্ধনপর্বত: মথুরা তীর্থের মাঝখানে রয়েছে গোবর্ধনপর্বত। এর চারদিকে চক্রাকারে মন্দিরগুলোর অবস্থান।

ভক্তরা হেঁটে মন্দিরগুলো দর্শন করেন। মন্দিরদর্শনের সমবেত এই যাত্রাকে বলা হয় ব্রজমণ্ডল পরিক্রমা। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এই পরিক্রিমা শুরু হয়।

দোলপূর্ণিমা, রাসপূর্ণিমা ও ঝুলনযাত্রা- এই তিনটি উৎসব মথুরা ও বৃন্দাবনের প্রধান উৎসব। ফাল্গুন মাসের শুরুপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে দোলপূর্ণিমা উৎসব উদ্যাপিত হয়। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ঝুলনযাত্রা উৎসব হয়। আবার, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে রাসপূর্ণিমা হয়। তখন ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বের বৈষ্ণব ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এই উৎসবে যোগ দিতে আসেন।

 

ভারতের যে-কোনো বড় শহর থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে বা দূরপাল্লার বাসযোগে মথুরা শহরে যাওয়া যায়। বিমানযোগে যাওয়ার জন্য প্রথমে আগ্রা বিমানবন্দরে নামতে হবে। আগ্রা থেকে মথুরার দূরত্ব মাত্র সাতান্ন কিলোমিটার। ট্যাক্সি বা গণপরিবহণে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মথুরায় পৌঁছানো সম্ভব। মথুরা শহর থেকে মূল তীর্থগুলো খুব কাছাকাছি। রিকশা বা অটোতে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মথুরা-তীর্থ দর্শন করা যায়।

 

অযোধ্যা আর মথুরা ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত নগর। এ সম্পর্কে এখানে যা তথ্য দেওয়া আছে, তার বাইরে আরও কিছু তথ্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এককভাবে সংগ্রহ করো। এরপর দলে বা জোড়ায় বা অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে লেখো।

 

ছক ২.১২: অযোধ্যা আর মথুরার কথা

অযোধ্যা

মথুরা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হরিদ্বার

 

ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হরিদ্বার জেলায় হরিদ্বার তীর্থের অবস্থান। হরিদ্বার অর্থ হরি বা বিষ্ণুর দরজা। অন্যদিকে শিবের ভক্তরা এর নাম দিয়েছেন হরদ্বার। হিমালয় হতে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা যে স্থানে সমভূমিতে প্রবেশ করেছে সেখানেই হরিদ্বার তীর্থের অবস্থান। সপ্ততীর্থের অন্তর্ভুক্ত এই তীর্থ অতি পবিত্র। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগীরথের বংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ৬০ হাজার পুত্র কপিল মুনির অভিশাপে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান। গঙ্গাজলের পবিত্র স্পর্শে তাঁদের উদ্ধার হবে, এই লক্ষ্যে ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সন্তুষ্ট হয়ে দেবী জলধারা রূপে পৃথিবীতে নেমে আসেন। সগরের সন্তানদের দেহাবশেষ গঙ্গাজলে সিক্ত হয়। ফলে তাঁরা উদ্ধার পেয়ে স্বর্গে চলে যান। সে কারণে ভক্তদের বিশ্বাস, পবিত্র এই তীর্থে গঙ্গার জলে স্নান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়, স্বর্গলাভ করা যায়। মহাভারতে পবিত্র এই তীর্থকে স্বর্ণদ্বার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

গঙ্গার দুই পাড়ে অপরূপ পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী। সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। মনে একধরনের আকর্ষণ বা মায়ার সৃষ্টি হয়। তাই এই তীর্থকে মায়াপুরীও বলা হয়। অন্যদিকে এই তীর্থ দর্শন করে জীবের মোহমায়া কেটে যায়। শাস্ত্রে তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে মায়াপুরী।

 

গঙ্গার পাড়ে রয়েছে শিবের বিশালাকার বিগ্রহ। দূর থেকে সহজেই যা চোখে পড়ে। বহমান গঙ্গার দুপাশে মাইলের পর মাইল পাথর দিয়ে বাঁধানো। স্থানে স্থানে পারাপারের সেতু ও বাঁধনো ঘাট। ঘাটগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্রহ্মকুণ্ডঘাট। স্থানীয় বাসিন্দারা একে 'হর কি পৌড়ি' বলেন। অর্থাৎ হরির প্রস্থানঘাট। ভারতবর্ষে অনুষ্ঠিত চারটি কুম্ভমেলার স্থানের মধ্যে এটি একটি। পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র-মন্বনের শেষে ধন্বন্তরি দেবতা অমৃতকুম্ভ নিয়ে উঠে আসেন। অমৃত হলো এক ধরনের পানীয় যা খেলে অমরত্ব লাভ করা যায়। আবার কুম্ভ হলো বড় আকারের পাত্র। অমৃতের সুরক্ষার্থে ভগবান নারায়ণ তা নিয়ে অন্যত্র রওনা দেন। তখন বিন্দু-পরিমাণ অমৃত কুম্ভ হতে হরিদ্বারের এই স্থানে পতিত হয়। কুম্ভ থেকে অমৃত পতিত হওয়ার কারণে মেলার নামকরণ হয়েছে কুম্ভমেলা। প্রতি ১২ বছর পরপর এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সূর্য ও বৃহস্পতি কুম্ভরাশিতে অবস্থান করলে হরিদ্বারে পূর্ণ কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

হরিদ্বারে ব্রহ্মকুণ্ডঘাটে সন্ধ্যার সময় গঙ্গাদেবীর আরতি হয়। ভক্তরা গাছের পাতার ছোট নৌকায় অর্ঘ্য সাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেন। সারাঘাট তখন আলোকময় হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্য অতি মনোরম।

ভারতবর্ষের বড় বড় শহর থেকে বাসযোগে সরাসরি হরিদ্বার যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে হলে বড় শহরের স্টেশন থেকে হরিদ্বার স্টেশনে নামতে হবে। হরিদ্বার স্টেশন থেকে তীর্থের দূরত্ব ২০ কিলেমিটার। বিমানে যেতে হলে বড় বড় শহরের বিমান বন্দর থেকে উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন নামতে হবে। দেরাদুন থেকে হরিদ্বারের দূরত্ব ৫১ কিলোমিটার। অটোরিকশায় এই দূরত্ব অতিক্রম করে সহজেই হরিদ্বারে পৌঁছানো সম্ভব।

 

বারাণসী

 

ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলায় বারাণসী তীর্থের অবস্থান। আসলে গঙ্গা নদীর দুটি উপনদী 'বরুণ' ও 'অসি' যা মিলে গঠিত হয়েছে বারাণসী। গঙ্গার সঙ্গে নদী দুটির মিলনের মধ্যবর্তী পবিত্র ভূমিই বারাণসী। বারাণসীর অন্য নাম কাশী। কাশীতীর্থ দর্শন করে মানুষের মোহ নাশ হয়। ভ্রান্ত জ্ঞান দূর হয়ে হৃদয় আলোকিত হয়। তাই এর নাম কাশী। মহাদেব কখনো এই পবিত্র স্থান ছেড়ে চলে যান না। তাই এই তীর্থের নাম দেওয়া হয়েছে অবিমুক্ত।

 

তীর্থের শহর বারাণসীতে ছোট-বড় মিলে প্রায় তেইশ হাজার মন্দির রয়েছে। তাই একে হিন্দুদের ধর্মীয় রাজধানী বলা হয়। মন্দিরগুলোর মধ্যে 'কাশী বিশ্বনাথমন্দির' অন্যতম। এখানে শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়, দ্বাদশ জ্যেতির্লিঙ্গের মধ্যে যা অন্যতম। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য মহাদেব তাঁদের মাঝে জ্যোতির্ময় লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হন। তাঁরই প্রস্তরীভূত রূপ জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানে মহাদেব সর্বদা বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। পূজার পাশাপাশি এখানে বৈদিক মন্ত্র পাঠ হয়, শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশিত হয়।

 

বিশ্বনাথমন্দিরের চূড়া এক হাজার কেজি ওজনের সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। পাশে জ্ঞানবাপি নামে একটি কুন্ড রয়েছে। কুন্ডের জলে স্নান করলে মূর্খেরও জ্ঞান লাভ হয়- এমন বিশ্বাস ভক্তদের রয়েছে।

 

সংকট-মোচনমন্দির বারাণসীর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির। সংকট থেকে মুক্তি দেন মহাবীর হনুমান। তাঁর নাম অনুসারে মন্দিরটির নামকরণ। হনুমানসহ এখানে রাম-সীতা পূজিত হন। তুলসীমানস মন্দির এখানকার একটি বড় মন্দির। হিন্দিভাষায় রামায়ণ রচয়িতা তুলসীদাসের নামে এই মন্দির। মন্দিরের নানা কক্ষে রামায়ণের কাহিনিকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। দেয়ালে লেখা রয়েছে রামায়ণের শ্লোক। রাম, সীতা ও হনু- মানের পাশাপাশি এখানে তুলসীদাসেরও পূজা করা হয়। আবার, উত্তরবঙ্গের নাটোরের (বর্তমান বাংলাদেশের) রানী ভবানী এখানে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে দশভুজা দুর্গাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির। নানা অলংকারে ভূষিত অন্নপূর্ণা দেবীকে এখানে পূজা করা হয়। দেবীর কৃপায় কাশীতে কোনো মানুষ খাবারের কষ্ট পান না- এমন লোকশ্রুতি রয়েছে।

 

 

বারাণসী তীর্থের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে পবিত্র গঙ্গা। গঙ্গাতীরে মোট ৮১টি ঘাট রয়েছে। দশাশ্বমেধ একটি উল্লেখযোগ্য ঘাট। পিতামহ ব্রহ্মা এখানে ১০টি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। 'দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়' মহাভারতে এমনটি বলা হয়েছে। আবার মণিকর্ণিকা ঘাটে শিবের কানের অলংকারের 'মণি' পড়েছিল। সতীর শবদেহ নিয়ে নৃত্য করার সময়ে এই ঘটনা ঘটে। তাই এর নাম মণিকর্ণিকা ঘাট। দানবীর হরিশ্চন্দ্রের নামে নির্মিত হয়েছে হরিশ্চন্দ্র ঘাট। হরিশ্চন্দ্র ও দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই কাশীর দুটি মহাশ্মশান। এখানে শবদাহ করলে মৃত ব্যক্তির দিব্যলোক প্রাপ্তি হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে। অন্যদিকে অসি নদী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে তৈরি হয়েছে অসিঘাট। এটিও একটি পবিত্র তীর্থ।

 

ঘাটগুলোতে গঙ্গাদেবীর সন্ধ্যা-আরতির দৃশ্য অতি চমৎকার। গঙ্গার ঘাটে সুসজ্জিত মঞ্চ নির্মিত হয়। ধুনুচিতে নানা সুগন্ধি দ্রব্য পোড়ানো হয়। আরতির জন্য নির্দিষ্ট ঝাড়-প্রদীপ জ্বালানো হয়। তারপর সুসজ্জিত পুরোহিতেরা প্রদীপ হাতে নিয়ে বাজনার তালে মঞ্চে নেচে নেচে গঙ্গার আরতি করেন। মনোরম সেই দৃশ্য দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত সেখানে সমবেত হন। ঘাটে জায়গা না পেয়ে কেউবা নৌকায় চড়ে গঙ্গাবক্ষে বসে আরতির দৃশ্য উপভোগ করেন।

 

বারাণসীর দুটি বড় উৎসব হলো মহাশিবরাত্রি উৎসব এবং গঙ্গা-উৎসব। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি পূজা অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের হয়, গঙ্গাবক্ষে আরতি হয়। আবার লঙ্কাজয় শেষে রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে গঙ্গা-উৎসব উদ্যাপিত হয়। ঐ দিন লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে মাটির পাত্রে করে গঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অমাবস্যার অন্ধকারে এই দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়।

 

ভারতের যে-কোনো বড় শহর থেকে ট্রেনে কিংবা বাসে চড়ে বারাণসীতে পৌঁছানো যায়। স্টেশনগুলো থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের মধ্যে। বিমানযোগে যেতে হলে প্রথমে বারাণসীর লালবাহাদুর শাস্ত্রী বিমান বন্দরে নামতে হবে। সেখান থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। অটোরিকশা বা ট্যাক্সিতে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মূল তীর্থ দর্শন করা সহজেই সম্ভব।

 

  • চারটি তীর্থস্থান সম্পর্কিত নিচের ছকটি পূরণ করো।

ছক ২.১৩: তীর্থস্থান-এর তথ্য

 

তীর্থস্থানের নাম

উৎসব (সময়/তিথি)

মন্দির

অবস্থান

উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিশ্বময় হিন্দুধর্ম

কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী হিন্দুধর্মের অনেক অনুসারী আছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা চমৎকার স্থাপনার অনেক মন্দির তৈরি করেছেন, এবারে আমরা সেইসব মন্দির এবং সেগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জানব।

 

পণ্ডিত চাণক্য বলেছেন 'বসুধৈব কুটুম্বকম্'। এ পৃথিবীতে সবাই সবার আত্মীয়। হিন্দুধর্ম এই বিশ্বজনীন ধারণাকে সমর্থন করে। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রার্থনায় সারা বিশ্বের সকল অস্তিত্বের মঙ্গল কামনা করা হয়।

 

সপ্তসিন্ধুর অববাহিকায় বিকশিত হওয়া হিন্দুধর্ম একটা সময় উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব অঞ্চলে হিন্দু রাজাদের নেতৃত্বে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল।

 

দক্ষিণ ভারতের কলিঙ্গ, চোল ও বিজয়নগরের রাজারা সমুদ্র অভিযানে উৎসাহ দিতেন। তাঁদের উৎসাহে এসব রাজ্যের বণিকরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বাণিজ্য বিস্তার করতে থাকেন। তাঁদের মাধ্যমে বর্তমান কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ও ইন্দোনেয়িশায় হিন্দুধর্মের প্রসার ঘটে। এখনো এসব অঞ্চলে হাজার হাজার প্রাচীন হিন্দু মন্দির রয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে নিয়মিত প্রাচীন মন্দিরগুলো আবিষ্কৃত হচ্ছে।

 

বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপকে একসময় যব দ্বীপ বলা হতো। জাভা ধান চাষের জন্য খুব উর্বর ভূমি ছিল। এখানে প্রচুর ধান হতো। পার্শ্ববর্তী দ্বীপ থেকে বিভিন্ন মসলা নিয়ে আসা হতো ধান কেনার জন্য। আবার ভারত ও আরব থেকে বণিকরা এখানে আসতেন মসলা কিনে নেওয়ার জন্য। এভাবে ভারতীয়রা এ অঞ্চলে যায়।

 

রাধেন বিজয় নামের এক হিন্দু রাজপুত্র মঙ্গোলিয়া থেকে আসা দখলদার থেকে জাভাকে মুক্ত করে ১২৯৪ সালে মাজাপাহিট রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে গজমদ নামের এক হিন্দু সেনাপতির নেতৃত্বে এ সা- ম্রাজ্য আরো বিস্তৃতি লাভ করে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি মাজাপাহিট সাম্রাজ্য পাপুয়া নিউগিনি থেকে মালয় দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। বর্তমান ইন্দোনেশিয়া দেশটি মূলত এই রাজবংশের সময় গঠিত হয়। আজকের মালয়েশিয়াও সেসময় এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 

 

 

১৩৯৮ সালে মাজাপাহিট সাম্রাজ্য প্রতিবেশী আরেকটি সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করে। সুমাত্রার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। শ্রীবিজয়ার রাজার ঘাঁটি ছিল বর্তমানের সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকে পিছু হটে রাজা প্রেমেশ্বর মালাক্কা দ্বীপে চলে যান।

 

এদিকে মাজাপাহিট রাজবংশ নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে দুর্বল হতে থাকে। একসময় শেষ মাজাপাহিট রাজা পশ্চিমের দিকে পালিয়ে গিয়ে মাউন্ট লাউয়ের এক হিন্দুমন্দিরে আশ্রয় নেন। এই রাজনৈতিক শূন্যতায় এ অঞ্চলে অন্য ধর্মের প্রসার শুরু হয়। এখনো ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে প্রায় ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী হিন্দুধর্মাবলম্বী। ইন্দোনেশিয়া নামটির সৃষ্টি ইন্ডিয়া ও এশিয়া দুটি শব্দের সংশ্লেষে তৈরি। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক ও মূলনীতিতে এখনো হিন্দুসংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়।

 

মাজাপাহিট সাম্রাজ্যের আগে অষ্টম শতাব্দীতে জাভা ও মালয় নিয়ে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য ছিল। ১০২৫ সালে চোল সাম্রাজ্যের আক্রমণে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের পরাজয় ঘটে। দিন দিন সাম্রাজ্যটি দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

নবম শতাব্দীতে হিন্দুরাজা জয়বর্মণের নেতৃত্বে কম্বোডিয়ায় বর্তমান খেমার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতকে রাজা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলে হিন্দুসাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষ এখনো হিন্দু দেবদেবীর পূজা করে।

 

সিঙ্গাপুর শব্দটি সংস্কৃত সিংহপুর শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সিংহের নগর। সাং নিলা উতামা এই রাজ্যের পত্তন ঘটান। মিয়ানামারের পূর্বনাম ছিল ব্রহ্মদেশ। কথ্যরূপে বার্মা বলা হতো। সেখানে কিছু হিন্দুরাজ্য ছিলো। ভিয়েতনামে চম্পারাজ্য নামে একটি হিন্দুরাজ্য ছিল। জাপান, কোরিয়া ও ফিলিপাইনের সংস্কৃতিতেও হিন্দুধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। জাপানের দেবদেবী বেনজাইটেন, কাঙ্গিতেন ও বিষমন্তেন যথাক্রমে হিন্দু দেবদেবী সরস্বতী, গণেশ ও কুবেরের প্রতিরূপ যেন।

 

এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নাম এখনো হিন্দু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে যাচ্ছে। যেমন- আফগানিস্তানের পূর্বনাম ছিল উপগণস্থান। কান্দাহার ছিল মহাভারতের উল্লিখিত গান্ধার রাজ্য। কম্বোডিয়ার নাম ছিল কম্বোজ। পেশোয়ার এসেছে পুরুষপুর থেকে। একইভাবে লাহোর লবপুর, কাশ্মীর কাশ্যপপুরী, মালয়েশিয়া মলয়দেশ, তিব্বত ত্রিবিষ্টপ থেকে এসেছে।

 

প্রাচীনকালে হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং সাগর-মহাসাগরের কারণে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে যেত না। ভারত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় অন্য অঞ্চলে যাওয়ার প্রয়োজনও তেমন অনুভূত হতো না। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, রেললাইন স্থাপন ইত্যাদির জন্য ভারত থেকে প্রচুর হিন্দুধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

 

ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিয়ানামার, মরিশাস, ফিজি, গুয়ানা, সুরিনাম, কাতার, আরব আমিরাতে হিন্দুজনগোষ্ঠী বসবাস করে।

 

প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দিরের বর্ণনা করা হলো

 

ইন্দোনেশিয়ার প্রম্বানান মন্দির

 

ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের যোগজাকার্তা রাজ্যে মন্দিরটি অবস্থিত। প্রাচীন জাভার বৃহত্তম এ হিন্দুমন্দিরটি নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি তৈরি হয়েছিল। এ মন্দিরের অদূরেই পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধমন্দির বরবুদুর স্থাপন করেছিল শৈলেন্দ্র রাজবংশ। এই রাজবংশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রতিবেশী সঞ্জয় রাজবংশ এটি স্থাপন করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

এটি মূলত একটি মন্দির কমপ্লেক্স। ৮টি ১৫৪ ফুট উঁচু মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে ২৪০টি মন্দির ছিল। অনেক মন্দির নষ্ট হয়ে গেলেও ৮টি বড় মন্দির এখনো টিকে আছে। এসব মন্দিরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের পূজা করা হয়।

 

এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রতি সন্ধ্যায় রামায়ণের ওপর গীতিনাট্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবছর হাজার হাজার বিদেশী পর্যটক এই গীতিনাট্য দেখতে আসে।

 

 

কম্বোডিয়ার আঙ্কোর ওয়াট হলো প্রস্বানান মন্দিরের মতো একটি মন্দির কমপ্লেক্স। ১৬২.৬ হেক্টর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ কমপ্লেক্স গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় কাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দ্বাদশ শতকে রাজা সূর্যবর্মণ দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে এ মন্দিরটি স্থাপন করেন। পরে এটি বৌদ্ধমন্দিরে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

আঙ্কোর ওয়াটের আক্ষরিক অর্থে 'রাজধানী মন্দির'। এই মন্দির কমেপ্লেক্স করতে ২৭ বছর সময় লেগেছিল।

 

মালয়েশিয়ার বাটু কেড

 

বাটু শব্দের অর্থ পাথর। পাথুরে গুহার একটি নেটওয়ার্ক এই বাটু কেভ। এখানে ১৪০ ফুট উচু মারুগানের মূর্তি আছে। ১৮৯০ সালে তামিল ব্যবসায়ী কে. থামবুসামি পিল্লাই এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে শ্রী সুব্রামনিয়াম স্বামী দেবস্থানম নামে একটি মন্দির আছে। বর্তমানে এটি মালয়েশিয়ার একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে থাইপুসাম নামে বিখ্যাত হিন্দু উৎসব উদ্যাপিত হয়। এতে যোগ দিতে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে পর্যটকেরা আসেন।

 

 

ইন্দোনেশিয়ার তানাহ লট মন্দির

 

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে সমুদ্রতীর ধরে সাতটি মন্দির সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। স্থানীয় ভাষায় তানাহ লট অর্থ সমুদ্রের ভূমি। সমুদ্র তীরবর্তী একটি পাথরের উপর মন্দিরটি অবস্থিত। এটি বালির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। ধারণা করা হয় হিন্দুধর্ম গুরু ডাং হায়াং নিরর্থ ষোড়শ শতকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার পূজিত দেবতা বরুণ।

 

 

মরিশাসের পূর্ব প্রান্তে এই মন্দির অবস্থিত। ২০০৭ সালে বিকাশ গুনোয়া এই মন্দির স্থাপন করেন। এখানে ১০৮ ফুট উচু ব্রোঞ্জের শিবের বিগ্রহ আছে। মন্দিরটি চারদিক থেকে লেক ও ম্যানগ্রোভ বন দ্বারা বেষ্টিত। খুব দৃষ্টিনন্দন এর নিসর্গ।

এছাড়া মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুর আরুলমিগু শ্রী রাজাকালিয়াম্মান কাচের মন্দির, ইংল্যান্ডের শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর (বালাজি) মন্দির, যুক্তরাষ্ট্রের রাধা মাধব ধাম, ওমানের মাস্কাটের শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, বার্মার ইয়াগুন শ্রীকালী মন্দির, ফিজির শ্রীশিব সুব্রাক্ষনিয়া মন্দির, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার শ্রীশিব বিষ্ণু মন্দির উল্লেখযোগ্য।

 

  • ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে দলে/জোড়ায় মন্দিরগুলোর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে উপস্থাপন করো। এসকল মন্দিরের বাইরেও অন্য কোনো মন্দির সম্পর্কে তথ্য থাকলে তাও শ্রেণিতে উপস্থাপন করতে পারো।

 

ছক ২.১৪: দূরদেশের মন্দির

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  • দলে/জোড়ায় পৃথিবীর মানচিত্রে বিভিন্ন দেশে হিন্দুজনগোষ্ঠীর অবস্থান ও সংখ্যা প্রকাশ করো।

 

 

  • দলে বা জোড়ায় আলোচনা করে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে তোমার/তোমাদের আত্মীয়/পরিচিত। কোনো হিন্দু ব্যক্তি আছে কীনা তা ভেবে বের করো। প্রয়োজনে অভিভাকের সাহায্য নিতে পার। এরকম কোনো ব্যক্তি থাকলে তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক (আত্মীয়/পরিচিত) লেখো। অভিভাব কের সাহায্য নিয়ে তার সাথে যোগাযোগের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করো। যোগাযোগের জন্য ইমেইল/ফোন/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করো।
  • বিভিন্ন দেশের হিন্দুজনগোষ্ঠী কীভাবে তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো পালনের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন রক্ষা করছে সে বিষয়ে দলে/জোড়ায় তথ্য সংগ্রহ করো। বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় উৎসব উপ স্থাপনের জন্য কী কী প্রয়োজন তার তালিকা করবে। বিভিন্ন দেশের পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে, সেই দেশের পতাকা, মানচিত্র, প্রতীক ইত্যাদি অনুষঙ্গ সঙ্গে নিয়ে দলে/ জোড়ায় ভূমিকা ভিনয়ের মাধ্যমে সেই দেশের ধর্মীয় উৎসবগুলো কীভাবে পালিত হয় তা উপস্থাপন করো।
  • তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের বিদেশে থাকা আত্মীয়-পরিচিতজনদের চিঠি লেখা, মেইল করা, মেসেজ দেওয়া বা কল করতে পারো। বিদেশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো; বিশেষ করে যেসব মন্দিরগু লোর কথা তোমরা জানলে সেসব মন্দির এবং অন্যান্য বিদেশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে ইমেইল ঠিকানা সংগ্রহ করে মেইল করার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহকরা যেতে পারে।

এসবের বাইরে অন্যান্য মাধ্যম থেকেও তথ্য সংগ্রহকরা যেতে পারে যেমন-সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্রিকা, ইন্টারনেট ইত্যাদি।

 

ছক ২.১৫: বিভিন্ন উপকরণের তালিকা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Content added || updated By
Promotion